সনাতন ঐতিহ্যে, পিতৃপক্ষের সময়কালকে অত্যন্ত পবিত্র বলে মনে করা হয়। এই সময়টি আত্মার পবিত্রতা এবং পূর্বপুরুষদের শান্তিরও একটি মাধ্যম। শাস্ত্রে বর্ণিত আছে যে এই সময়কালে করা প্রতিটি সৎকর্ম বহুবিধ ফল দেয়। এই কারণেই এই সময়ে পূর্বপুরুষদের তর্পণ করা এবং ভাগবত মূলপাঠ বা শ্রীমদ্ভাগবত কথা শোনা বিশেষভাবে শুভ এবং কল্যাণকর বলে বিবেচিত হয়।
পিতৃপক্ষকে মহালয়া পক্ষও বলা হয়। এই সময় জীবিত প্রজন্ম তাদের পূর্বপুরুষদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। বিশ্বাস করা হয় যে এই দিনগুলিতে পূর্বপুরুষদের আত্মা পৃথিবীতে আসেন এবং তাদের বংশধরদের তর্পণ এবং স্মরণের জন্য অপেক্ষা করেন। যখন আমরা ভক্তি সহকারে তর্পণ করি এবং ভাগবত কথা শুনি, তখন পূর্বপুরুষদের আত্মা তৃপ্তি লাভ করে এবং তারা আমাদের আশীর্বাদ করে এবং মুক্তির পথে এগিয়ে যায়।
শ্রীমদ্ভাগবত কেবল একটি গ্রন্থ নয়, বরং ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অমৃত-সদৃশ লীলা এবং শিক্ষার ভান্ডার। এতে ভক্তি, জ্ঞান এবং অনাসক্তির এক অপূর্ব সঙ্গম রয়েছে। এই গ্রন্থটি আত্মাকে পরমাত্মার সাথে সংযুক্ত করার একটি সেতু। যখন এটি পাঠ করা হয়, তখন প্রতিটি অক্ষর, প্রতিটি শ্লোক পরিবেশকে মন্ত্রের মতো পবিত্র করে। কেবল জীব নয়, অদৃশ্য পূর্বপুরুষদের আত্মারাও এই পবিত্র ধ্বনিতে তৃপ্ত হয়।
জ্যোতিষশাস্ত্র এবং ধর্মীয় শাস্ত্রে পিতৃদোষের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। যদি কোনও পূর্বপুরুষের শেষ ইচ্ছা অপূর্ণ থাকে, অথবা আচার-অনুষ্ঠান অনুসারে শ্রাদ্ধ কর্ম না করা হয়, তবে তার আত্মা অস্থির থাকে। এর প্রভাব বংশধরদের উপরও দৃশ্যমান হয়। ভাগবত কথা শোনার মাধ্যমে এই দোষ শান্ত হয়। শাস্ত্রে বলা হয়েছে যে কেবল ভাগবত কথা শোনার মাধ্যমে পাপ বিনষ্ট হয় এবং এর পুণ্য ফল পূর্বপুরুষদের কাছে পৌঁছায় এবং তাদের তৃপ্তি দেয়।
বিশ্বাস এবং ভক্তির শক্তি: যখন শিশুরা তাদের পূর্বপুরুষদের স্মরণে গল্প শোনে, তখন তাদের বিশ্বাস এবং ভক্তি পূর্বপুরুষদের কাছে পৌঁছায়। এই অনুভূতি আত্মাদের জন্য অমৃতের মতো।
ভাগবত বাণীর প্রভাব: শ্রীমদ্ভাগবতের বাক্যগুলিকে স্বয়ং ঈশ্বরের রূপ বলে মনে করা হয়। এটি শ্রবণ করলে আত্মা পরিশুদ্ধ হয় এবং পূর্বপুরুষদের দিব্য শান্তি প্রদান করে।
মুক্তির পথ: ভাগবতের মূল পাঠে বর্ণিত ভক্তি ও জ্ঞান আত্মাকে মুক্তির দিকে নিয়ে যায়। যখন এই পুণ্যের ফল পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে নিবেদন করা হয়, তখন তাদের আত্মা বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে উচ্চতর জগতে চলে যায়।
আত্মিক তৃপ্তি: পূর্বপুরুষরা কেবল খাদ্য ও জল দিয়েই তৃপ্ত হন না, বরং এই ষোল দিনে আবেগ, বিশ্বাস এবং ধর্মীয় কর্ম সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। ভাগবতের মূল পাঠ শুনে তারা সেই আত্মিক তৃপ্তি পান, যা কোনও বস্তুগত দান দ্বারা পাওয়া যায় না।
আজও, আমাদের গ্রাম ও শহরে এই উপলক্ষে ভাগবত কথা বিশেষভাবে আয়োজন করা হয়। পরিবার ও সমাজ একসাথে গল্প শোনে এবং সেই পুণ্য তাদের পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করে। আজকাল অনেকেই অনলাইনে বা টিভিতে ভাগবত মূলপাঠও শোনেন। যদিও মাধ্যম বদলেছে, কিন্তু ভক্তি এবং অনুভূতি একই। বলা হয় যে যেখানে ভাগবতের কণ্ঠস্বর প্রতিধ্বনিত হয়, সেখানে পূর্বপুরুষদের আত্মা অবশ্যই শান্তি পায়।
পিতৃপক্ষের গুরুত্ব কেবল আচার-অনুষ্ঠানের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এই সময় আমাদের শিকড়ের সাথে সংযুক্ত করে, আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদের প্রতি ঋণী। যখন আমরা ভক্তি সহকারে ভাগবত মূলপাঠ করি, শ্রাদ্ধ করি, তখন আমাদের পূর্বপুরুষরা কেবল সন্তুষ্টি এবং শান্তি পান না, বরং আমরা আধ্যাত্মিক অগ্রগতি এবং মুক্তির পথও পাই।
তাই যদি সম্ভব হয়, ভাগবত কথা শ্রাবণ করুন। এই আচার পূর্বপুরুষদের কল্যাণ, তাদের আত্মার শান্তি এবং পরিবারের সুখ ও সমৃদ্ধির জন্য একটি ঐশ্বরিক উপায়।